পৃথিবী জুড়ে কার্বন অশনি

কার্বন জ্বালায় পুড়ছে পৃথিবী। বাড়ছে উষ্ণায়ন। গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ভূমি হয়ে পড়ছে সীমিত। রীতি ভঙ্গ করে ভিন্ন আচরণ করছে জলবায়ু। কখনো অনাবৃষ্টি, কখনো অতিবৃষ্টি। খরা আর বন্যাও ভোগাচ্ছে মানুষকে। নিয়মিত সৃষ্টি হচ্ছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। আর তা তীব্রভাবে আঘাত হানছে উপকূলে। 

ক্রান্তিকাল ছাড়া আর কী নামে ডাকা যায় সভ্যতার এই লগ্নকে! এই দুর্যোগে তাই নেই কোনো সুখবর।

গত বছরের শেষে অর্থাৎ ডিসেম্বরে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়েছে বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেশি। গত বছর অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমন হয়েছে। একে রেকর্ড হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন বিজ্ঞানিরা। 

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক রব জ্যাকসন এ পরিস্থিতিকে ‘আতঙ্কজনক’ উল্লেখ করে বলেন, ‘এক বছরে এই পরিমাণ দূষণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।’

আবার লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- রেকর্ড পরিমাণ কার্বন নির্গমনের পরও বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ব্যবহার বেড়েছে। সৌরশক্তি ব্যবহারের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়। এই সোলার প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারত আছে তৃতীয় স্থানে। কিন্তু চীন একাই যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে সৌরশক্তি ব্যবহার এর অর্ধেকেরও কম। 

ব্লুমবার্গ নিউ এনার্জি ফিন্যান্সের সোলার এনালিস্ট জেনি চেজ এমন তথ্যই জানিয়েছেন।   

রব জ্যাকসন দীর্ঘ দিন ধরে কার্বন নির্গমন নিয়ে গবেষণা করছেন। গত বছর এ নিয়ে তার তিনটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। সেগুলো হলো- এনভায়েরমেন্টাল রিসার্চ লেটার, ন্যাচার ক্লাইমেট চেঞ্জ ও আর্থ সিস্টেম সায়েন্স ডাটা। এ গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে কার্বন নির্গমন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রবণতার ওপর আলোকপাত করা যাক। 

রব জ্যাকসনের গবেষণায় উঠে এসেছে- পৃথিবীর জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কার্বন নির্গমন সম্পর্কিত। দ্রুত প্রবৃদ্ধির কারণে বেশি পরিমাণ কার্বন নিসৃত হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০১৯ সালে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৩ শতাংশ হারে। একই বছর কার্বন নির্গমন বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ২ শতাংশ হারে। 

আইএমএফের মতে, চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে ৩ শতাংশ হারে। ধারণা করা হচ্ছে, এর প্রভাবে কার্বন নির্গমন বাড়বে আগের বছরের চেয়ে ০.৬ শতাংশ হারে। 

জ্যাকসন মনে করেন, প্রবৃদ্ধি থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। বরং কমাতে হবে কার্বন নির্গমন। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি আর কার্বন নির্গমন চক্রের পারস্পরিক সম্পর্ক ভেঙে দেয়াই হবে আজকের পরিবেশমুখীর কর্তব্য। যদিও তা কতটুকু সম্ভব আর কোন প্রক্রিয়ায়- এর উত্তর অজানা। কারণ এখন পর্যন্ত বিশ্ব পুঁজিবাদ সুস্পষ্টই পরিবেশনাশী।

আরো কয়েকটি বিষয় রব জ্যাকসনের গবেষণায় উঠে এসেছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে কয়লা পোড়ানো জ্বালানির কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। সে তুলনায় চীনে এ সংক্রান্ত মৃত্যুর হার কম। 

বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশে কয়লা ব্যবহার কমে আসায় কার্বন দূষণও কমেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গত বছর কয়লার ব্যবহার কমপক্ষে ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কয়লার ব্যবহার উল্লেখ করার মতো হ্রাস পেয়েছে। যা এখন বছরে মাত্র ৫ শতাংশ বলে মনে করা হচ্ছে। 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো ২০১০ সাল থেকে পাঁচ শতাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। নতুন কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। সম্প্রতি দেশটি তা জানিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৫ সাল থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় এটি দেখা গেছে।

তবে কয়লার ব্যবহার সর্বত্রই হ্রাস পাচ্ছে না। গত বছর চীনে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। এখন বিশ্বব্যাপী কয়লা উৎপাদনের কমপক্ষে অর্ধেকের জন্য চীন দায়ী বলে জ্যাকসন উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য জ্বালানি থেকেও চীনের কার্বন নির্গমন বাড়ছে। গত বছর তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও সিমেন্ট উৎপাদন থেকে কার্বন দূষণ আগের বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে বলে রব জ্যাকসন খুশি নন। কারণ এখনো সেখানে বড় ধরনের সৌরশক্তি বা উইন্ডমিলের প্রচলন দেখা যাচ্ছে না। তাই নির্ভরতা থেকে যাচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুবিধা আছে, তা হলো- সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাস অনেক সস্তা। 

রব জ্যাকসন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, প্রাকৃতিক গ্যাস ওই বছর পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি ছিল। যা প্রায় ৭.৭ বিলিয়ন টন কার্বন দূষণ করে।

ইউরোপেও প্রাকৃতিক গ্যাস সস্তা হওয়ায় তা কয়লা থেকে দূরে রাখছে অঞ্চলটিকে। প্রাকৃতিক গ্যাস জ্বালানি হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। একটি পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সিস্টেমের প্রস্তুতি নেয়ার সময়ে কয়লা নির্গমন হয়ে আছে গলার কাঁটা। 

রব জ্যাকসন এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি খরচ বাড়ছে ও অতিরিক্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের বেশিরভাগই অতিরিক্ত জ্বালানির চাহিদা মেটাচ্ছে। গত বছর ভারতে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার প্রায় আড়াই শতাংশ বেড়েছে। জাপানে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক জ্বালানির পরিমাণ কমে গেছে। জাপান এখন তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের বৃহত্তম আমদানিকারক।

জ্যাকসন ও তার সহকর্মীরা গবেষণায় বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন প্রকল্পের দিকে দৃষ্টি দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বিশ্বকে আবাসযোগ্য করতে কার্বন নির্গমন হ্রাস, জলবায়ুর উষ্ণায়ন রোধ ও সমুদ্রকে দূষণ মুক্ত করে তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আর এটি করতে হবে এই গ্রহে মানব জীবন শেষ হওয়ার আগেই। 

তারা সতর্ক করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে। যেখানে পৃথিবীর সুসময় নির্ভর করছে বিশ্বনেতাদের কূটনীতি ও বাণিজ্যিক স্বার্থের ওপর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //